|
লেখা স্বত্ব: রাকিবুল হাসান।
বিখ্যাত চিন্তাবিদ নোম চমস্কি একটা চমকে দেওয়ার মতো কথা বলেছেন। উনি বলেছেন, মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ করতে প্রতি বছর শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। কীভাবে হয় এটা? একটা সাধারণ উদাহরণ দিয়ে শুরু করি বরং। আচ্ছা, আপনি কি লক্ষ্য করেছেন গত এক সপ্তাহে কতবার ‘এআই’ শব্দটা শুনেছেন? টিভিতে দেখছেন এআই নিয়ে টক শো। ফেসবুকে দেখছেন এআই নিয়ে পোস্ট। ইউটিউবে এআই টিউটোরিয়াল। এমনকি আড্ডার টেবিলেও এআই নিয়ে আলোচনা। এটা কি আসলেই স্বাভাবিক? নাকি কেউ চাইছে আপনি এআই নিয়ে ভাবুন?
বড় বড় টেক কোম্পানিগুলো জানে, এআই হবে সামনের দিনের বড় বিজনেস। তাই তারা চায় আপনার মাথায় ঢুকিয়ে দিতে যে এআই ছাড়া আপনি পিছিয়ে পড়বেন। এজন্য তারা কী করে? প্রথমে মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন দেয়। তারপর এক্সপার্টদের দিয়ে টক শো করায়। ইনফ্লুয়েন্সারদের দিয়ে প্রমোট করায়। ধীরে ধীরে আপনার মনে একটা ভয় ঢুকে যায় — “আমি কি পিছিয়ে পড়ছি?”
রাজনীতিতে এটা আরও ভয়ঙ্করভাবে হয়। একটা পার্টি কীভাবে মানুষের মন জয় করে? প্রথমে লাইসেন্স দেয় নিজেদের মানুষদের, টিভি চ্যানেল দিতে। তারপর বড় বড় পিআর ফার্ম হায়ার করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজার হাজার ফেক আইডি খুলে প্রচার চালায়। নিজেদের পক্ষে সার্ভে রিপোর্ট ছাপায়। এসব করতে যে কোটি কোটি টাকা লাগে, সেটা দেয় বড় বড় বিজনেস গ্রুপ। কিন্তু এখানেই শেষ না। সাইকোলজিস্টরা বলছেন, এখন ‘ইমোশনাল মার্কেটিং’ হচ্ছে। মানে, আপনার আবেগের সাথে খেলা করা। যেমন, একটা পলিটিক্যাল অ্যাড দেখাবে গরিব মা-বাবার মেয়ে ডাক্তার হয়েছে মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে। বা দেখাবে একজন কৃষক স্মার্টফোনে ডাকবিভাগ দিয়ে রেমিটেন্স পাচ্ছে ছেলের কাছ থেকে। এভাবে আমাদের মনে একটা ইমোশনাল বন্ড তৈরি হয়।
তাহলে কী করা যায়? প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে এই খেলাটা। বুঝতে হবে কীভাবে আমাদের মন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তারপর নিজেদের চিন্তা করতে হবে নিজেদেরকেই। দরকার হলে মিডিয়া থেকে একটু দূরে সরে যেতে হবে। দুরে থাকতে হবে ‘সহমত’ গ্রুপ থেকে। যত বেশি সচেতন, তত কম নিয়ন্ত্রিত হবার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, আসল গণতন্ত্র তখনই কাজ করে যখন মানুষ নিজে থেকে চিন্তা করে, নিজে সিদ্ধান্ত নেয়। আর সেজন্যই দরকার মনের স্বাধীনতা। ‘আসল’ শিক্ষা তার একটা বড় উপকরণ।
গত সপ্তাহে মজার একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। বড় বড় মিডিয়া হাউসগুলো হঠাৎ করে কমলা হ্যারিসকে নিয়ে পজিটিভ খবর দিতে শুরু করল। একদিন ইকোনমিস্ট ‘এনডোরস’ করলো কমলাকে“ ”, আরেকদিন “আমেরিকার নতুন আশা।” এত হঠাৎ এই পজিটিভ প্রচার কেন? কারণটা সোজা — তারা টের পেয়ে গিয়েছিল ট্রাম্প জিতছেন। তাই শেষ চেষ্টা — জনমত পাল্টানোর।
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে দেখি অন্য ছবি। মানুষের মতামত একই আছে। কেউ পাল্টায়নি, নড়েনি। বরং অনেকে স্পষ্ট লিখছে — “দেখছেন? মিডিয়া কীভাবে আমাদের ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা করছে!”
বড় মিডিয়া হাউসগুলো এখনো মনে করে তারা মানুষের মন কিনতে পারে। তাই কোটি কোটি ডলার খরচ করে। কিন্তু মানুষ আর আগের মত সহজ টার্গেট না। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তারা নিজেরাই তথ্য খোঁজে। নিজেরাই সত্য মিথ্যা যাচাই করে।
নোম চমস্কির সেই বিখ্যাত “ম্যানুফ্যাকচারড কনসেন্ট” এখন আর তেমন কাজ করে না। কারণ মানুষ এখন বোঝে কখন তাদের মন নিয়ে খেলা করা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিকল্প মতামত আছে। লোকেরা নিজেরাই ফ্যাক্ট চেক করে।
শেষ কথা — পুরনো মিডিয়ার সেই ক্ষমতা হয়তোবা নেই আর। যেখানে তারা একতরফা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে মানুষের মন পাল্টাতে পারত। এখন অনেক জিনিস মানুষ যাচাই করে দেখে। এটাই আসল গণতন্ত্রের জয়। মানুষের মনের স্বাধীনতার জয়।